
সোহেল রানা : বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)— দেশের নদীপথ, বন্দর ও টার্মিনাল উন্নয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। নদীমাতৃক বাংলাদেশের এই সংস্থাটি রাষ্ট্রের বিপুল বাজেট ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন প্রকল্পে নিয়োগ, পদোন্নতি, কাজের গুণগত মান এবং অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষে চাকরি করতেন নিজাম উদ্দিন পাঠানের এক আত্মীয়। সেই সুবাদে নিজাম উদ্দিন পাঠান “অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার” পদে চাকরি পান।
সুত্রমতে, অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার থাকা অবস্থায় কয়েকজন বড় ঠিকাদারের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এরপর তাদের সহায়তায় ধীরে ধীরে নির্বাহী প্রকৌশলীর পদ বাগিয়ে নেন। তারপর থেকে নিজাম উদ্দিন পাঠানকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। হয়ে ওঠেন বিআইডব্লিউটিএর অঘোষিত চেয়ারম্যান ও গডফাদার। তার নামে-বেনামে রয়েছে বনশ্রী রামপুরায়, জে ব্লক দুইটা এপার্টমেন্ট ।। এস ব্লক একটা।। সি ব্লক তিনটা ও আশেপাশে অসংখ্য সম্পদ, প্লট ও বাড়ি। গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী হওয়ায় কাউকে তেমন পাত্তা দেন না। গুঞ্জন রয়েছে, অফিস ও ঘর—দুই জায়গাতেই রয়েছে তার “স্ত্রী”।নিজাম উদ্দিন পাঠান বাঘাবাড়ি প্রকল্পের পিডি থাকা অবস্থায় করেছেন রাষ্ট্রের সম্পদ তছরুপ ও হরিলুট। তার বিরুদ্ধে এত অভিযোগ যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় তার চাকরিতে থাকারই কথা নয়। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তিনি বাগিয়ে নিয়েছেন প্রকল্পের ৫০০ কোটি টাকা। বাঘাবাড়ি নদী বন্দর আধুনিকায়নের নামে করেছেন নিজের আধুনিকায়ন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মোহাম্মদ জাফর নামে এক ঠিকাদারকে ৫০০ কোটি টাকার কাজ পাইয়ে দেন নিজাম উদ্দিন পাঠান। কাজ পাইয়ে দিয়ে তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় ১০০ কোটি টাকা। রাষ্ট্রের সম্পদ হরিলুট করা এই পিডির খুঁটির জোর কোথায়? নগরবাড়ী-বাঘাবাড়ি প্রকল্পে বাস্তবে কিছু না করেই ঠিকাদারের সঙ্গে আঁতাত করে বিল উঠিয়ে নিয়েছেন।
একাধিক সূত্র জানায়, সেই দুর্নীতির টাকা দিয়ে মোহাম্মদ জাফরের সঙ্গে ডেভেলপার ব্যবসায় পার্টনার হন। প্রায় ২৪০ কোটি টাকার কাজ পাইয়ে দিয়েছেন “এস এস রহমান কোম্পানি”-র মালিক মোহাম্মদ দিপুকে, সেখান থেকেও টাকা আত্মসাৎ করেছেন নিজাম উদ্দিন পাঠান।টাকা আত্মসাৎ করার কারণে এসি পিডি খানপুর নিজাম উদ্দিন পাঠানের বিরুদ্ধে প্রকল্পের সব ফাইল প্রস্তুত করেছে এবং তার বিরুদ্ধে সচিবালয়ে অভিযোগ পৌঁছেছে। ইতিমধ্যে সচিবালয় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। সূত্রটি আরো জানায় , বিআইডব্লিউটিএ-তে চাকরি পাওয়া অনেক সময়ই ন্যায্য যোগ্যতার ওপর নির্ভর করে না—বরং প্রভাব, পরিচিতি ও অর্থনৈতিক যোগসাজশের মাধ্যমেই গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ বা পদোন্নতি পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। এর ফলে সংস্থাটিতে এমন এক পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যেখানে সততা নয়, বরং প্রভাবই হয়ে উঠেছে সফলতার চাবিকাঠি। সূত্রমতে, বিআইডব্লিউটিএ-র একাধিক প্রকৌশল বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে “পারিবারিক কোটায়” নিয়োগের প্রথা চলছে। কোনো কর্মকর্তা অবসরে গেলে বা মারা গেলে তার আত্মীয়-স্বজন, এমনকি দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়রাও নানান প্রক্রিয়ায় ওই পদে সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন। এতে মেধা ও দক্ষতার পরিবর্তে জন্মসূত্রে সুবিধা পাওয়া ব্যক্তিরাই এগিয়ে যাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে।বিআইডব্লিউটিএ-র প্রকৌশল বিভাগে এমন কিছু কর্মকর্তা আছেন, যারা শুরু করেছিলেন নিম্নপদ থেকে, কিন্তু সময়ের সঙ্গে প্রভাব, সম্পর্ক ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় দ্রুতই উন্নীত হয়েছেন উচ্চপদে। ঠিকাদারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দে প্রভাব বিস্তার, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় প্রভাব খাটানোসহ নানা উপায়ে নিজেদের অবস্থান শক্ত করেছেন তারা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিভিন্ন বড় প্রকল্প—যেমন নগরবাড়ী নদী বন্দর আধুনিকায়ন, বাঘাবাড়ী নদী টার্মিনাল উন্নয়ন, খানপুর পোর্ট ডেভেলপমেন্ট ইত্যাদিতে বাজেটের বিপুল অঙ্কের টাকা ব্যয়ের হিসাব ও বাস্তবায়নের মানের মধ্যে অসামঞ্জস্য পাওয়া গেছে। প্রকল্পের নামে শত কোটি টাকার কাজ হলেও বাস্তবে মাঠপর্যায়ে কাজের মান অনেক ক্ষেত্রেই নিম্নমানের বা অসম্পূর্ণ। টেন্ডার ও ঠিকাদারি যোগসাজশ : বিআইডব্লিউটিএ-র প্রকল্পগুলোর বড় অংশই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হয়। এই ঠিকাদারদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি। অভিযোগ রয়েছে—অভ্যন্তরীণ প্রভাব খাটিয়ে নির্দিষ্ট কিছু ঠিকাদার বারবার একই প্রকল্পের কাজ পাচ্ছেন, আবার অনেক ক্ষেত্রেই কাজের অগ্রগতি বা গুণগত মান যাচাই না করেই বিল পরিশোধ সম্পন্ন করা হচ্ছে। একজন অভিজ্ঞ ঠিকাদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, “যে কর্মকর্তা বা প্রকল্প পরিচালক ঠিকাদারদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে পারেন, তিনি সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকেন। যারা নিয়ম মেনে কাজ করতে চান, তারা বরং নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েন।” সম্প্রতি একাধিক প্রকল্পে দুর্নীতি, অনিয়ম ও সম্পদ গড়ার অভিযোগে প্রশাসনিক তদন্ত শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। সচিবালয়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বিভিন্ন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) ও নির্বাহী প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে নিরীক্ষা প্রতিবেদন জমা পড়েছে। এসব প্রতিবেদনে কাজের গুণগত মান, বিল পরিশোধ, টেন্ডার প্রক্রিয়া এবং সম্পদের অসামঞ্জস্য নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন তোলা হয়েছে। তদন্ত কমিটি সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের নথি, বিল, ভাউচার ও পেমেন্ট হিসাব পর্যালোচনা করছে। কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, একাধিক প্রকল্পে একই কাজের জন্য বারবার বিল উত্তোলন করা হয়েছে; আবার কোথাও মাঠপর্যায়ে কাজ বাস্তবায়ন না করেই কাগজে সম্পূর্ণ দেখানো হয়েছে। অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, কিছু প্রভাবশালী ঠিকাদার ও কর্মকর্তা মিলে নিজেদের মধ্যে “ডেভেলপার ব্যবসা” চালু করেছেন। প্রকল্পের টেন্ডার ও বিলের টাকা দিয়ে তারা বেসরকারি ভবন নির্মাণ, জমি ক্রয় ও ব্যবসায়িক অংশীদারিত্বে জড়িয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে সরকারি তহবিল থেকে অর্থ আত্মসাৎ ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আরও জোরালো হয়েছে। একটি





