
আব্দুল মজিদ, নাটোর:নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার একটি সাধারণ গ্রাম খন্দকার মালঞ্চি, যেখানে কৃষিভিত্তিক জীবনযাপনই অধিকাংশ মানুষের নিত্যদিনের বাস্তবতা। এই গ্রামেই বাবা আশরাফ আলী ও মা আতেজান বেগমের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন আব্দুল বারী বাকিবিল্লাহ, যিনি এখন স্থানীয়ভাবে একজন প্রখ্যাত ফলচাষী, উদ্যোক্তা এবং শতাধিক পরিবারের জীবিকার ভরসা।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল পেরিয়ে ১৯৯৫ সালে কলেজে ভর্তি হলেও সংসারের অভাব-অনটনে থমকে যায় তার পড়ালেখা। পরিবারের হাল ধরতে বাধ্য হয়ে নিজের ভবিষ্যৎ বদলানোর কঠিন সিদ্ধান্ত নেন। চাকরি নয়, নিজেই উদ্যোক্তা হবেন-এই ভাবনা থেকেই যাত্রা শুরু তার।
শুরুটা হয়েছিল মাত্র আড়াই বিঘা জমিতে পেঁপে চাষ দিয়ে। বাবা-মায়ের দেয়া জমিকে কাজে লাগিয়ে ধাপে ধাপে এগিয়ে যান তিনি। ২০০৭ সালে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ‘তন্ময় দাস’ ও কৃষি কর্মকর্তা ‘সুভ্রত বাবু’ তার পাশে দাঁড়ান এবং ফল বাগান করার পরামর্শ দেন। সেই উৎসাহে শুরু করেন মাল্টা ও ড্রাগনের মতো উচ্চমূল্যের ফলের চাষ।
বর্তমানে তার ‘রিক্ত-বিত্ত কৃষি খামার’ এ পেয়ারা, ড্রাগন, বারমাসি আম, মাল্টা, কলা, কমলা, আনারস সহ নানা জাতের ফল উৎপাদিত হচ্ছে। খামারে এখন প্রায় ২০০ বিঘা জমিতে চাষ হচ্ছে। তার প্রজেক্ট শুধু বাগাতিপড়াতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। তিনি রাজশাহীর-গোদাগাড়ী, নাটোরের লালপুর ও নিজ উপজেলা বাগাতিপাড়া সহ বিভিন্ন স্থানে বিস্তার করেছেন। শুধু মাল্টা চাষেই রয়েছে ৪৫ বিঘা, যেখানে চলতি মৌসুমে তার প্রত্যাশিত আয় প্রায় কোটি টাকা। এই খামারে কাজ করেন প্রায় ১০০ জন শ্রমিক।
শ্রমিক ইমরান আলী বলেন, আমি ১৬ বছর ধরে এখানে কাজ করছি। খামার মালিক অত্যন্ত মানবিক। আমাদের অসুস্থতায় কাজ না করলেও তিনি মজুরী দেন, এমনকি চিকিৎসার খরচও বহন করেন। আমাদের পরিবারগুলো এই খামারের আয়ে চলে।”
শুধু শ্রমিকদের জীবনমান নয়, এই খামারী নিজ গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী এলাকার সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনেরও রোল মডেল হয়ে উঠেছে।
আব্দুল বারী বাকিবিল্লাহ ফলের মিষ্টতা ও নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা দিতে অর্গানিক চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করেন। নাইট্রোজেনের ব্যবহার সীমিত রেখে তিনি স্বাস্থ্যসম্মত ফল উৎপাদনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তার উৎপাদিত ফল ঢাকা, রাজশাহী সহ দেশের নানা বাজারে পাঠানো হয়।
মাসিদুল ইসলাম শিপন নামের একজন ফল ব্যবসায়ী জানান, এই বাগানের ফল ভেজালমুক্ত। আমি প্রতিদিন প্রায় ১০০ মন পেয়ারা, ৬০-৭০ মন মাল্টা ঢাকার মোকামে পাঠাই।”
নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. হাবিবুল ইসলাম খান বলেন, বাকিবিল্লাহর মাল্টা বাগান পরিদর্শন করেছি। তার উৎপাদিত মাল্টা খুবই মিষ্টি এবং চাহিদাসম্পন্ন। আমরা তাকে সবধরনের প্রযুক্তিগত সহায়তা দিচ্ছি।”
খামার পরিদর্শেনে আসা সাবেক এ্যাডিশনাল ডাইরেক্টর মনজুর-উল হক বলেন, আমি একসময় নাটোরের ডিডি ছিলাম। আমরা ২০১৭ সাল থেকে মাল্টা চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করলেও সবাই সফল হননি। কিন্তু বাকিবিল্লাহর চাষপদ্ধতি প্রশংসনীয়। তার বাগান রিসার্চ ও লার্নিং সেন্টার হিসেবে কাজ করতে পারে।”
বাগাতিপাড়া উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ ড. ভবসিন্ধু রায় বলেন, তিনি শুধু একজন সফল চাষী নন, বরং তিনি একটি ফল হাব-গড়ে তুলেছেন। তার খামার পুষ্টি নিরাপত্তা, বেকারত্ব দূরীকরণ এবং কৃষিভিত্তিক উদ্যোক্তা গড়ে তুলতে দারুণ একটি উদাহরণ। তাকে নিয়ে কৃষি দপ্তরের পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি রাষ্ট্রিয় স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য, আমরা লিখেছি আশা করছি তিনি স্বীকৃতি পাবেন।”
নিজের সংগ্রামের গল্প বলতে গিয়ে বাকিবিল্লাহ বলেন, ‘চাকরির আশায় বসে থাকলে আজ আমি এখানে পৌঁছাতে পারতাম না। নাটোরের সাবেক ডিডি খামার বাড়ীর ভারপ্রাপ্ত পরিচালক থাকা অবস্থায় আব্দুল আওয়াল মহোদয় আমার খামারে এসেছেন এবং তিনি প্রজেক্টের উন্নয়নে ও ফলের গুণগতমান বৃদ্ধির জন্য নিয়মতি পরামর্শ ও উৎসাহ দিয়েছেন। এমনকি কৃষি অধিদপ্তরের এ্যাডিশনাল ডাইক্টের হযরত আলী স্যার সম্প্রতি আগষ্ট মাসে এসে খামার পরিদর্শন করে স্থানীয় কৃষি দপ্তরকে আরো বেশী নজরদারী রাখার পরামর্শ দিয়েছেন।’ তিনি এরা বলেন- ‘উদ্যোক্তা হতে হলে ঝুঁকি নিতে হয়, সাহস রাখতে হয়। সৃষ্টিকর্তার উপরে ভরশা রেখে আমি সেই ঝুঁকি নিয়েছিলাম।’
স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা মনে করেন, আব্দুল বারী বাকিবিল্লাহর মতো কৃষি উদ্যোক্তারা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়ার দাবিদার। কারণ, আমদানিনির্ভর ফল তিনি উৎপাদন করে দেশের চাহিদা পূরণ করছেন।
অভাবের তাড়না থেকে উঠে আসা একজন মানুষ এখন একটি বৃহৎ কৃষি উদ্যোগের সফল নেতৃত্ব দিচ্ছেন। রিক্ত-বিত্ত কৃষি খামার আজ শতাধিক পরিবারের জীবিকা, দেশের পুষ্টির উৎস, এবং নতুন উদ্যোক্তাদের প্রেরণার উৎস।
এমন মানুষদের নিয়ে পরিকল্পিত গবেষণা, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সহযোগিতা দেওয়া গেলে বাংলাদেশে কৃষিভিত্তিক উদ্যোক্তার সংখ্যা বহুগুণে বাড়বে-যা কর্মসংস্থান ও পুষ্টি নিরাপত্তার জন্য অত্যন্কত গুরুত্বপূর্ণ।