সোহেল রানা : বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) আজ পরিণত হয়েছে দুর্নীতি ও লুটপাটের এক মডেল সংস্থায়। বিশ্বব্যাংকের ঋণ অর্থায়নে বাস্তবায়িত বিআইডব্লিউটিপি-১ প্রকল্প—যা দেশের সবচেয়ে বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প—তারই পরিচালক পদে রয়েছেন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আইয়ুব আলী, যিনি দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার দম্ভে রাষ্ট্রীয় অর্থ লুটে গড়ে তুলেছেন এক বিশাল সাম্রাজ্য।সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এপিএস ও সাবেক আওয়ামী লীগের এমপি সাইফুজ্জামান শিখরের ভায়রা পরিচয় ব্যবহার করে আইয়ুব আলী বিগত দেড় দশক ধরে দুর্নীতির এমন এক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন যা প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে বিষ ছড়িয়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ এর দোসর - সে কিভাবে এখনো প্রকল্প পরিচালক থাকে! তার তো জেলে থাকার কথা - জনমনে নানান প্রশ্ন? বিআইডব্লিউটিপি-১ প্রকল্পের পরিচালক মো. আইয়ুব আলীর বিরুদ্ধে। মন্ত্রী, ঠিকাদার ও প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে আঁতাত করে তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন শত শত কোটি টাকার সরকারি অর্থ। বিআইডব্লিউটিপি-১ প্রকল্পের পরিচালক মো. আইয়ুব আলীর ধনসম্পদের কাহিনী যেন আলাদীনের চেরাগকেও হার মানায়। সরকারি চাকরিজীবী হয়েও তিনি আজ রীতিমতো এক প্রভাবশালী ধনকুবের। দীর্ঘ ১২ বছরে (২০১২-২০২৪) তিনি ও তার পরিবারের নামে গড়ে তুলেছেন অগণিত ফ্ল্যাট, প্লট, খামার, জমি ও বিদেশে বাড়িঘর—যার পরিমাণ শত কোটি টাকায়। দেশে-বিদেশে অঢেল সম্পদের পাহাড়। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, আইয়ুব আলী শুধু ঢাকা নয়—ফতুল্লা, কেরানীগঞ্জ, রূপগঞ্জ, পূর্বাচল, সাভার, আশুলিয়া, কালীগঞ্জ, ভৈরব, বাঘারপাড়া এমনকি নিজ জেলা মাগুরার বিভিন্ন এলাকায় জমি ও বাড়ির মালিক হয়েছেন। এসব সম্পদ তিনি নিজের নামের পাশাপাশি স্ত্রী ফারজানা নাহিদ লিজা, ছেলে নাভিদ ফারহান ঐশিক, মেয়ে পূর্ণতা ফারজানা এবং ভাই-বোনদের নামে ক্রয় করেছেন। স্ত্রীর নামে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ৩ কাঠার প্লটে ৭ তলা ভবন নির্মাণাধীন, বারিধারা ডিওএইচএস-এ দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, পশ্চিম ধানমণ্ডি, জিগাতলা ও হাজারিবাগে একাধিক ফ্ল্যাট—সবই তার পরিবারের দখলে। আশুলিয়ায় গরুর খামার, আশুগঞ্জে ৫০ শতাংশ জমিতে মুরগির খামার ও ১০ কোটি টাকার বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপনের কাজও চলছে তার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। প্রকল্প থেকে কমিশন—ব্যক্তিগত সম্পদে রূপান্তর, আইয়ুব আলীর নিয়ন্ত্রণে থাকা বিভিন্ন ড্রেজিং প্রকল্পে ভয়াবহ অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতি ঘনমিটারে অতিরিক্ত বিল দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। ড্রেজিং কার্যক্রমে ইচ্ছাকৃতভাবে কম কাজ দেখিয়ে, তেল চুরি করে এবং পলি অপসারণের হিসাব ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়ে সরকারি অর্থ লোপাট করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান—বঙ্গ ড্রেজার্স লিমিটেড ও কর্ণফুলী ড্রেজিং লিমিটেড—এর সঙ্গে যোগসাজশে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা বিল উত্তোলনের ঘটনায় আইয়ুব আলীর সংশ্লিষ্টতার তথ্যও মিলেছে। এমনকি গণমাধ্যমের কিছু অসাধু কর্মীকেও এই সিন্ডিকেট নাব্যতা-সংকটের খবর প্রচারের মাধ্যমে নতুন প্রকল্প অনুমোদনে ব্যবহার করে বলে অভিযোগ উঠেছে। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা নৌপথ প্রকল্পে কোটি টাকার অপচয়। বর্তমানে আইয়ুব আলী ‘চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত নৌপথের নাব্যতা উন্নয়ন প্রকল্প’-এর পরিচালক। প্রকল্পটিতে ড্রেজিংয়ের নামে বিপুল অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এর আগে তিনি সমাপ্ত প্রকল্পের ড্রেজার ও আনুষঙ্গিক জলযান ক্রয় প্রকল্পেও জড়িত ছিলেন, যেখানে নিম্নমানের ১১টি ড্রেজার কিনে সরকারি অর্থ লোপাট করা হয়। অভিযোগ, ক্ষমতার অপব্যবহার ও ঘুষের রাজত্ব - ২০২৪ সালে ৩০০ কোটি টাকার বুড়িগঙ্গা তীর রক্ষা প্রকল্পে ঠিকাদার নির্বাচনে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ঠিকাদারদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের পর নিজেই হামলার শিকার হন—যার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। বিদেশে সম্পদ: দুর্নীতির অর্থ পাচার। সূত্র মতে, আইয়ুব আলী ২০২১ সালে লন্ডনে ও ২০২৩ সালে নিউইয়র্কে বাড়ি ক্রয় করেছেন। তার দুই ছেলে অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থান করছে—যেখানে তাদের নামে বিপুল সম্পদ ক্রয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে। পরিবারসহ তিনি প্রতি বছর দুইবার বিদেশ ভ্রমণ করেন। বিতর্কিত প্রতিক্রিয়া- নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে আইয়ুব আলী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান এবং প্রতিবেদককে “তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করতে” বলেন। পরে ফোন কেটে দেন। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, “আমি ওর দায় নিতে পারবো না।” বিআইডব্লিউটিএ’র এই উচ্চপদস্থ প্রকৌশলী আজ দুর্নীতির প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। সরকারি পদকে ব্যবহার করে অবৈধ অর্থ, প্রভাব ও ক্ষমতার জাল বুনে তৈরি করেছেন এক “ড্রেজিং সাম্রাজ্য”—যেখানে নীতি, ন্যায়, ও জবাবদিহিতা বহু আগেই বিলীন হয়ে গেছে।