
আলম খান: আজ সোমবার (২৮ জুলাই) সাবেক স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী এবং বিএনপির সাবেক মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার ১৫তম মৃত্যু বার্ষিকী।
দিবসটি উপলক্ষে আ:মান্নান ভুঁইয়া পরিষদ পক্ষে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আরিফ উল ইসলাম মৃধা প্রতি বছরের ন্যায় আ:মান্নান ভুঁইয়া অনুসারীদের নিয়ে আ:মান্নান ভুইঁয়ার সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজনের পাশাপাশি আ: মান্নান ভুঁইয়া সহযোদ্ধা, রাজনৈতিক, সামাজিক, সংগঠনগুলো এই দিনটি যথাযোগ্য মর্জাদায় পালন করেন। এ উপলক্ষে নরসিংদী -৩(শিবপুর) আসনের প্রতিটি মসজিদ, মন্দিরে প্রার্থনার আয়োজন করা হয়।
উল্লেখ্য ২০১০ সালে এই দিনে তিনি ঢাকা একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ১৯৪৩ সালের ১ মার্চ মনোহরদী উপজেলার চন্দনবাড়ী ইউনিয়নের আসাদনগর গ্রামে নানা সৈয়দ আলী পন্ডিতের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করে ছিলেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি শিবপুর উপজেলার মাছিমপুর ইউনিয়নের মাছিমপুর গ্রামে।শিক্ষা জীবন শুরু হয়ে ছিল তার গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। শিবপুর হাই স্কুল থেকে এসএসসি ও নরসিংদী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে পরবর্তীতে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইতিহাস বিভাগ থেকে অনার্স এবং মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন মান্নান ভূঁইয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির পাশাপাশি তিনি এলএলবি ডিগ্রিও অর্জন করে ছিলেন।স্কুল জীবনেই রাজনীতির সাথে যুক্ত হন মান্নান ভূঁইয়া। কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন তিনি। ছাত্র ইউনিয়নের সাথে সম্পৃক্ততার মধ্য দিয়ে তার ছাত্র রাজনীতির যাত্রা শুরু।
১৯৬০ সালে মান্নান ভূঁইয়া নরসিংদী কলেজ ছাত্র সংসদে সমাজসেবা সম্পাদক নির্বাচিত হন। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের অন্যতম সংগঠক হিসেবে ১৯৬২ সালে তিনি আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং পরবর্তীতে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয়েছিলন।
১৯৬৪-৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে কার্যনির্বাহী সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন) কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ততার অভিযোগে ছাত্র জীবনেই কারাবরণ করতে হয়েছিল মান্নান ভূঁইয়াকে। অনার্স পরীক্ষার আগে তাকে গ্রেপ্তারও করে আইয়ুব সরকার। ছাত্রজীবন শেষে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ এ যোগ দেন মান্নান ভূঁইয়া।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যূত্থানে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন তিনি। ন্যাপ থেকে মান্নান ভূঁইয়া ১৯৭৮ সালে ইউনাইটেড পিপলস পাটির (ইউপিপি) সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮০ সালে মান্নান ভূঁইয়া সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আহ্বানে বিএনপিতে যোগ দেন। দায়িত্ব পান দলের অঙ্গসংগঠন জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের আহ্বায়কের। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির কৃষি বিষয়ক সম্পাদকও ছিলেন।
১৯৮৮ সালে মান্নান ভূঁইয়াকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৯৬ সালের ২৫ জুন পর্যন্ত টানা সাড়ে ৮ বছর এ পদে দায়িত্ব পালন করেন। একই বছরের ২৬ জুন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া তাকে দলের মহাসচিব মনোনীত করেন। টানা ১১ বছর মান্নান ভূঁইয়া বিএনপির মহাসচিব ছিলেন।
১/১১-এর রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর জরুরি অবস্থার সময় দলের পক্ষ থেকে সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করলে বেগম জিয়া ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মহাসচিব পদ এবং দল থেকে মান্নান ভূঁইয়াকে বহিষ্কার করেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তিনি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। নরসিংদীর শিবপুরসহ বিশাল এলাকা জুড়ে তিনি মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। তিন অঞ্চলের কমান্ডার ছিলেন। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তিনি বিএনপির অন্যতম রূপকারও ছিলেন।
১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের শ্রম ও জনশক্তি এবং পরে কৃষি ও খাদ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বে ৪ দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। জোট সরকারের তিনি স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবনে মান্নান ভূঁইয়া দুই ছেলের জনক। বড় ছেলে ভূঁইয়া আনিন্দ মোহায়মেন রাজন অস্ট্রেলিয়ায় একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে কর্মরত। ছোট ছেলে ভূঁইয়া নন্দিত নাহিয়ান সজন অ্যামেরিকা সিটি চার্টাস ব্যাংক বাংলাদেশ এ কর্মরত।
স্ত্রী অধ্যাপক মরিয়ম বেগম ছিলেন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ। পরে অধ্যক্ষ পদ থেকে অবসরে যান এবং ২০২১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধিন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
মান্নান ভূইয়া পঞ্চম জাতীয় সংসদ থেকে টানা চারবার নরসিংদী-৩ শিবপুর আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে ছিলেন। সর্বশেষ ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে পরাজিত হন।
বিএনপি থেকে বহিষ্কারের ২২ মাস পর দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তিনি ২০১০ সালের ২৮ জুলাই প্রথম প্রহরে রাজধানী ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বিশিষ্ট এ রাজনীতিবিদ।
মৃত্যুর পর তাকে শিবপুর শহিদ আসাদ কলেজ সংলগ্ন ধানুয়া নিজ বাড়িতে সমাহিত করা হয়।
বাংলাদেশের জননন্দিত রাজনীতিবিদ একনেতা ছিলেন আব্দুল মান্নান ভূইয়া। তিনি মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ছিলেন আপোষহীন এক যোদ্ধা। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক থেকে বাংলাদেশ জাতীয়বাদী দল (বিএনপি)’র মহাসচিব পদে দীর্ঘ পথ চলায় কখনো তার আর্দশের পরিবর্তন ঘটেনি। এ মহান ব্যক্তি ছিলেন সুশাসন বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী।