লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে মসজিদের দানের টাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গা দখল করে পাঁচটি দোকানঘর নির্মাণ করেছেন স্থানীয় মসজিদ পরিচালনা কমিটির এক সভাপতি। মসজিদের উন্নয়নের নামে এ দোকানগুলো নির্মান করা হলেও বিগত ১১ বছর ধরে ভাড়া উত্তোলনের অন্তত ১২ লাখ টাকা মসজিদকে না দিয়ে সভাপতি নিজেই আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ মুসল্লীদের।
অভিযুক্ত আব্দুজ জাহের উপজেলার চর লরেন্স ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ডের কোম্পানি রাস্তার মাথা সংলগ্ন হাজী আলী হোসেন জামে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ; ও একই এলাকার আজিজ বেপারি বাড়ির মৃত আলী হোসেনের ছেলে। তিনি ওই এলাকার আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী একজন কর্মী।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৩ সালে রামগতি-লক্ষ্মীপুর আঞ্চলিক সড়ক সংলগ্ন কোম্পানি রাস্তার মাথায় হাজী আলী হোসেন নামে একটি জামে মসজিদ স্থাপন করেন স্থানীয়রা। প্রতিষ্ঠার পর অভিযুক্ত আব্দুজ জাহেরের বাবা আলী হোসেন মসজিদকে ১৫ শতক জমি দান করেন। সেই সুবাধে স্থানীয়রা আব্দুজ জাহেরকে ওই মসজিদের সভাপতি নির্বাচিত করেন।
সভাপতি হওয়ার পর ২০১৪ সালের শেষের দিকে কমিটির অন্যান্য সদস্যদের প্রলোভন দিয়ে মসজিদের সীমানায় থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডের জমি দখল করে পাঁচটি দোকানঘর উত্তোলন করেন। এতে মসজিদের তহবিলে থাকা টাকা ব্যায় করা হয়। দোকানগুলো নির্মাণের পর তা ভাড়া দেন আব্দুজ জাহের । স্থানীয়দের অভিযোগ, দোকানের ভাড়ার টাকা মসজিদের উন্নয়নকাজে ব্যায় করার কথা থাকলেও তা না করে বিগত ১১ বছর ধরে ওই পাঁচটি দোকানঘর ভাড়ার অন্তত ১২ লাখ টাকা সভাপতি জাহের নিজেই আত্মসাৎ করেন। নিজেকে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাধর নেতাদের আত্মীয় ও আওয়ামী লীগের কর্মী এমনটা দাপট দেখিয়ে সে মসজিদের সকল আয় নিজেই ভোগ করেন। ভয়ে মুসল্লীরা তার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করার সাহস পাননি। সেক্রেটারি নিজাম উদ্দিন মাঝে মধ্যে তার এসব অপকর্মের বিরোধিতা করলেও অপমান অপদস্ত হওয়ার ভয়ে তটস্থ থাকতেন বলে জানান মুসল্লীরা।
স্থানীয় মুসল্লী আবদুল মতিন জানান, আব্দুজ জাহের সভাপতি থাকাকালীন মসজিদের জমি দখল করে বাউন্ডারি ওয়াল তুলে পারিবারিক কবরস্থান বানিয়েছেন। এসব অপকর্মের প্রতিবাদ করায় বিভিন্ন সময়ে আব্দুজ জাহের তার বিরুদ্ধে ৮টি মিথ্যা মামলা দিয়েছেন। পরবর্তী তদন্তকালে ছয়টি মামলা খারিজ হয়ে যায়। এখনো দুইটি মামলা চলমান আছে। তিনি আরও বলেন, আব্দুজ জাহের আওয়ামী লীগের প্রভাব এব নিজের চার ছেলে বিদেশে থাকার দাপটে এলাকায় যা ইচ্ছে তাই করছেন। কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বললেই নানা কৌশলে তার নির্যাতনের শিকার হতে হয়। যে কারণে ৫ তারিখের পটপরিবর্তনের আগে তার বিরুদ্ধে ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস পাননি।
স্থানীয় জাহাঙ্গীর হোসেন, আবুল কাশেম, হেলাল উদ্দিন, মো. মানিক ও আব্দুস শহীদ সহ অনেকেই জানান, প্রতারক আব্দুজ জাহের মসজিদের সভাপতি পদ ব্যবহার করে লাগামহীন অনিয়ম দূর্ণীতিতে জড়িয়ে পড়েন। মসজিদে মানুষের দানের টাকায় নির্মিত ৫টি দোকান নিজের মালিকানা দাবি করে ১১ বছরের ভাড়ার টাকা আত্মসাৎ করেন। যে কারণে সম্প্রতি তাকে মসজিদের সভাপতির পদ থেকে অব্যহতি দেন মুসল্লিরা। সেই ক্ষোভে বৃহস্পতিবার সকালে মসজিদের পাশে মুয়াজ্জিনের থাকার একটি ঘর নিজের মালিকানা দাবি করে মুয়াজ্জিনকে ঘরটি ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে । মুয়াজ্জিনের থাকার জন্য আরেকটি ঘর ঠিক করার আগেই ক্ষমতার দাপটে ঘরটি ইটের দেয়ালে অবরুদ্ধ করে সেখানে আরেকটি দোকানঘর নির্মাণের কাজ শুরু করে আব্দুজ জাহের। পরে সমাজের মুসল্লীরা এক হয়ে বাধা দিলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোক এসে কাজ বন্ধ করে দেন।
হাজী আলী হোসেন জামে মসজিদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো.আলী আহাম্মদ বলেন, আব্দুজ জাহের মসজিদের সভাপতি থাকাকালীন সময়ে তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাৎ এর ঘটনা প্রমানিত হলে মুসল্লিরা তাকে সভাপতি থেকে অব্যাহতি দেন। সেই ক্ষোভে মসজিদের মুয়াজ্জিনের ঘরটি নিজের দাবি করে তা অবরুদ্ধ করে দেয়াল তুলে দোকানঘর নির্মাণের কাজ শুরু করে সে। পরে মুসল্লীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজনকে খবর দিলে তারা এসে কাজ বন্ধ করে দেন। তিনি বলেন, আব্দুজ জাহের মসজিদের সভাপতি থাকাকালীন সময়ে সম্পুর্ন মনগড়া স্বীদ্ধান্তে মসজিদে মানুষের দানের টাকা খরচ করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গায় পাঁচটি দোকান ঘর উঠান। দখল করা পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওই জায়গাটি মসজিদের নামে লিজ আনার কথা বলে প্রতারণার মাধ্যমে গোপনে নিজের নামে আবেদন করেন। মসজিদকে ঠকিয়ে নিজের নামে জায়গাটি লিজ পাওয়ার আবেদনের বিষয়টি খুবই দু:খজনক জানিয়ে তিনি বলেন, এসব অপকর্মের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সমাজের মুসল্লীরা জাহেরকে সভাপতি পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। পাশাপাশি তার আত্মসাত করা টাকা ও দোকানঘর উদ্ধারে সমাজের লোকজন নিয়ে শীঘ্রই বৈঠকে বসার কথা রয়েছে বলে জানান তিনি।
মসজিদের টাকায় দোকানঘর উত্তোলন পরবর্তী ভাড়ার টাকা মসজিদকে না দেয়ার কথা স্বীকার করে অভিযুক্ত আব্দুজ জাহের বলেন, মসজিদ নির্মাণের সময়ে মাটি ভরাট করতে গিয়ে তার অনেক টাকা খরচ হয়েছে ; যে কারণে দোকান ঘর ভাড়ার টাকা তিনি মসজিদকে দেননি। মুয়াজ্জিনের থাকার ঘর অবরুদ্ধ করে দেয়াল নির্মাণ ও দোকান উত্তোলনের বিষয়ে তিনি বলেন, মসজিদটি খাস জমিতে নির্মিত। মসজিদের পাশের জমিটিও খাস, তাই জমিটি লিজ পেতে আমি পানি উন্নয়ন বোর্ড বরাবর আবেদন করেই কাজ করছি। পানি উন্নয়ন বোর্ড আবেদন গ্রহণ করে জমিটি আপনাকে লিজ দিয়েছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেননি তিনি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সেকশন অফিসার আবদুর রহিম বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গায় দোকানঘর নির্মানের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে সত্যতা পাই। তাই দখলকারী আবদুজ জাহেরকে সতর্ক করে নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিয়েছি। আগের নির্মিত পাঁচটি দোকানঘর উচ্ছেদের বিষয়ে উর্ধতন কর্মকর্তাকে অবহিত করা হবে।
লক্ষ্মীপুরের জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ উজ-জামান খান বলেন , খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।