
সয়াল্যান্ড খ্যাত লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগর উপজেলায় এবার ২৯ হাজার পাঁচশ হেক্টর জমিতে সয়াবিন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে উপজেলা কৃষি অফিস। এতে দু’উপজেলায় চলতি মওসুমে সয়াবিন উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ৬৫ হাজার ৫০ মেট্রিক টন। যার আনুমানিক বাজারমুল্য ধরা হয়েছে প্রায় ৩৯০ কোটি টাকা।
তবে আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে উৎপাদনের পরিমাণ লক্ষমাত্রাকেও ছাড়িয়ে যাবে এমনটা মনে করা হলেও প্রকৃতিক বৈরী আবহাওয়ার কারণে লক্ষমাত্রা অর্জনে শংকা দেখা দিয়েছে। মওসুমের অর্ধেকরও বেশি সময় অতিবাহিত হলেও বৃষ্টি না হওয়ার ফলে গাছে ফল আসলেও তা রুষ্ট হচ্ছেনা বলে অভিযোগ কৃষকদের।
কৃষকরা বলছেন, উপকূলীয় এলাকা হওয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলোচ্ছাস ও অতিবৃষ্টির কারণে প্রতিবছরই ফসল হানি ঘটে। এবার আবহাওয়া এখনো অনুকূলে থাকলেও হচ্ছেনা বৃষ্টি। যে কারণে জমি লবনাক্ত হয়ে ঝলসে যাচ্ছে সয়াবিনের গাছ। এতে উৎপাদন লক্ষমাত্রা ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্যানুযায়ী, এবার রামগতি ও কমলনগর উপজেলায় মোট ২৯ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে সয়াবিন আবাদ করা হয়েছে। হেক্টর প্রতি জমিতে উৎপাদন লক্ষমাত্রা ২.৩ মেট্রিক টন হারে মোট ৬৫ হাজার ৫০ মেট্রিক টন সয়াবিন উৎপাদন লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে। এরমধ্যে রামগতিতে ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে সয়াবিন চাষ হয়েছে । এতে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৭ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন। যার বাজার মুল্য ২২৫ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে । অন্যদিকে কমলনগরে ১২ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে সয়াবিন চাষ করা হয়েছে। এতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ২৭ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। যার বাজার মূল্য প্রায় ১৬৫ কোটি টাকা।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, রামগতি- কমলনগরে
চলতি রবি মওসুমে সয়াবিনের লক্ষমাত্রা অর্জনে দুই উপজেলার অন্তত ৪ হাজার ২শ’ কৃষকদের মাঝে উচ্চফলনশীল নতুন জাতের সোহাগ-১, বারি-২, বারি-৩ জাতের সয়াবিনের বীজ বিতরণ করা হয়েছে। সাথে প্রণোদনা হিসেবে প্রতিজন কৃষককে ১০ কেজি করে সার (এমওপি ও ড্যাপ) দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৯ হাজার হেক্টর জমিতে উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৫২ হাজার মেট্রিক টন। কৃষি বিভাগ বলছে, উচ্চফলনশীল নতুন জাতের সোহাগ -১, বারি-২, বারি-৩ জাতের সয়াবিন চাষ করে ভালো ফলন পেয়েছেন কৃষকরা। ২০২৩-২৪ বিপনন বছরে ২৯ হাজার হেক্টর জমিতে উচ্চফলনশীল নতুন জাতের সোহাগ -১ প্রতি হেক্টর ১.৮ ও বারি-২ বারি -৩, হেক্টর প্রতি ২.১ মেট্রিক টন হারে প্রায় ৫০ মেট্রিক টন সয়াবিন উৎপাদন লক্ষমাত্রা অর্জিত হয়। উৎপাদিত সয়াবিন পোলট্রি খাদ্য, ফিশ ফিড, সয়া নাগেট, সয়াবিস্কুট, সয়ামিট, সাবান, সয়াদুধ, শিশু খাদ্যসহ অন্তত ৬১ ধরনের পুষ্টিকর খাদ্য ও পণ্য তৈরিতে ব্যবহার হয় বলে জানান উপজেলা কৃষি অফিস কর্মকর্তা।
কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, বছরে দুবার সয়াবিন উৎপাদন করেন চাষীরা। প্রথমবার আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি সয়াবিন বীজ আবাদ করা হয়, যা খরিপ-২ মৌসুম নামে পরিচিত। দ্বিতীয়বার পৌষ মাসের মাঝামাঝি থেকে মাঘ মাসের শুরুর দিকে কৃষকরা রবি শস্য হিসেবে সয়াবিনের আবাদ করেন। উপজেলার হাজিরহাট ইউনিয়নের চর জাঙ্গালিয়া গ্রামের কৃষক মো. সেলিম বলেন, চলতি মওসুমে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ভয়াবহ বন্যার কারণে পুরো এলাকা দীর্ঘদিন যাবত পানিতে নিমজ্জিত ছিল। যে কারণে সয়াবিন চাষের বীজ বপনে প্রায় এক মাস দেরি হয়েছে। সাধারণত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ হতে জানুয়ারি মাসের মধ্যে সয়াবিন বীজ বপন করতে হয়। সেক্ষেত্রে এবার প্রায় এক মাস দেরিতে বীজ বপণ করতে হয়েছে। তবে দেরিতে বীজ বপণ করলেও গাছে ফল আসতে শুরু করেছে। প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে রক্ষা পেলে এবারও ভালো ফলন ঘরে তুলতে পারবেন বলে আশা তার।
কমলনগরের চর মার্টিন ইউনিয়নের কৃষক মো.সাইফুল্লাহ বলেন, কৃষি অফিসের থেকে বীজ সহায়তা পেয়ে এক একর জমিতে সয়াবিন আবাদ করেছেন তিনি। বৃষ্টির না হওয়ার ফলে গাছে ফল আসলেও দানা পুষ্ট হচ্ছেনা। কৃষি অফিসের লোকজনের পরামর্শ অনুযায়ী পরিচর্যা করছি। তবে বৃষ্টি খুব দরকার বলে জানান তিনি।
রামগতির চর পোড়াগাছা গ্রামের কৃষক সফিক জমাদার বলেন,এ বছর দুই একর জমিতে সয়াবিন চাষ করেছি। এখানকার মাটির গুণাগুণ ভালো। তাই ফলন ভালো হয়। ১৫ বছর ধরে ধান, সয়াবিন ও সবজির চাষ করছি। প্রতি বছরেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর অতিরিক্ত জোয়ারের পানিতে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু এই ক্ষতি থেকে কাটিয়ে উঠতে সরকারি সহযোগিতা পেলে সয়াবিন চাষের প্রতি আরও আগ্রহ বাড়বে বলে জানান তিনি।
স্থানীয় আছিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. সারোয়ার মিরন বলেন, রামগতি ও কমলনগরে উৎপাদিত সয়াবিন স্থানীয় বাজারসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে যাচ্ছে। খাদ্য উৎপাদনে রামগতির কৃষকরা ভূমিকা রাখছেন। কিন্তু কৃষিপণ্য বাজারজাতের ক্ষেত্রে কৃষকদের ঠকতে হয়। তারা ন্যয্যমূল্য পাননা। পণ্য বাজারজাতে সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা প্রয়োজন। এতে কৃষি উৎপাদনে উৎসাহিত হবেন কৃষকরা। উপজেলার আশ্রম পোলেরগোড়া এলাকার স্মার্ট সয়াবিন ক্রয় বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের মালিক জসিম উদ্দিন বলেন, মওসুমে প্রতি মণ সয়াবিন ২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়। এতে স্থানীয় বাজারেই লেনদেন হয় অন্তত দেড়শ’ কোটি টাকারও অধিক । এতে কৃষক ও ব্যবসায়ী উভয়ই লাভবান হন।
কমলনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ( রামগতিতে অদা:) মোহাম্মদ শাহীন রানা বলেন, দেশের অন্যান্য উপজেলার তুলনায় রামগতি ও কমলনগরে অধিক পরিমাণে সয়াবিনের চাষ হয়। এখানকার কৃষকরা সয়াবিন চাষের প্রতি খুবই আগ্রহী, যে কারণে কৃষি অফিস থেকে কৃষকদের বীজ ও সার সাপোর্ট দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, সাধারণত ১০০ দিনের মধ্যে সয়াবিনের ফসল ঘরে তোলা যায়। সেক্ষেত্রে এবার প্রাকৃতিক দূর্যোগ আর বন্যার কারণে এখানকার বীজতলা পানিতে নিমজ্জিত থাকায় বীজ বপনে কৃষকরা প্রায় ১ মাস দেরি করতে হয়েছে। তার পরেও প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে রক্ষা পেলে লক্ষমাত্রা অর্জন হবে বলে আশা করছেন তিনি।
এম/শা/কা/ আর ক