লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে ইটভাটার সংখ্যা ৪০টি। এরমধ্যে ৩৮টি হচ্ছে অবৈধ। দু'টির বৈধতা থাকলেও একই ইউনিয়নে গড়ে তোলা হয়েছে অন্তত ৩২টি ইটভাটা।অপরদিকে কমলনগরে মোট ইটভাটা হচ্ছে ২০টি। এরমধ্যে অবৈধ ১৪টি। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র আছে ছয়টির। তবে দুর্দান্ত-দাপটের সাথে সবকটিই চলছে। চলছে শিশুশ্রম। পোড়ানো হচ্ছে কাঠ।
এসব অবৈধ ইটভাটা বন্ধে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণের আবেদন জানিয়ে অন্তবর্তীকালীন সরকারের ' বন ও পরিবেশ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দ রেজওয়ানা হাসান বরাবর গত ১৮ সেপ্টেম্বর তারিখে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক মো. রাকিব হোসেন স্বাক্ষরিত একটি চিঠি পাঠানো হয়। ওই চিঠি পরবর্তী রামগতির এক ইউনিয়নেই অবৈধভাবে ৩২ ইটভাটা গড়ে ওঠা নিয়ে প্রেস ব্রিফিং করে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান উপদেষ্টা সৈয়দ রেজওয়ানা হাসান।
এদিকে বন ও পরিবেশ উপদেষ্টার নির্দেশনামুলক ( প্রেস ব্রিফিং) বক্তব্যের দুই মাস পেরুলেও স্থানীয় প্রশাসন সিকি পরিমাণও ব্যবস্থা নেয়নি। বরং এর মালিকরা প্রশাসনের নাকের ডগায় হাঁকডাক দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে অবৈধ এসব ইটভাটা।
সচেতন মহলের মতে, শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে প্রশাসন এসব ইটভাটা বন্ধে কোনো ধরনের উদ্যোগ নেয়নি বরং সুবিধা নিয়েছেন। এখন অন্তবর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে ব্রিফিং করে জানালেও স্থানীয় প্রশাসন (ইউএনও) কার্যকরী ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। মাঝে মধ্যে অভিযান পরিচালনা করলেও তা আগেই যেনে যান ভাটা মালিকরা। ফলে অভিযান হয় লোকদেখানো।
জানা যায়, অনুমোদনহীন এসব ইটভাটা বন্ধে স্থানীয়রা বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করে আসলেও জেলা-উপজেলা প্রশাসন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বরং ইটভাটার কয়েকজন মালিক জানালেন,তারা প্রশাসনকে টাকা দিয়েই এসব অবৈধ ইটভাটা পরিচালনা করছেন।
এমন একজন ভাটার মালিক কমলনগর উপজেলার চরকাদিরা ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের চরবসু এলাকার আকাশ ব্রিকস ও তোরাবগঞ্জ ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের চরপাগলা গ্রামের মাদিনা ব্রিকসের মালিক আরিফ। তিনি দুটি অবৈধ ইটভাটা চালিয়ে যাচ্ছেন। যোগাযোগ প্রতিদিনকে তিনি বলেন, আমরা হাইকোর্ট থেকে অনুমতি নিয়ে ভাটা চালাই। স্থানীয় প্রশাসন আমাদেরকে এখন পর্যন্ত কিছুই বলেনি।
অন্যদিকে তোরাবগঞ্জ ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের চরপাগলা গ্রামে মদিনা ব্রিকস, ৪নং ওয়ার্ডে হাসিনা ব্রিকস, ৮নং ওয়ার্ডের এলএমবি ব্রিকস, ৬নং ওয়ার্ডের রহিমগঞ্জে তাহেরা ব্রিকস, ৭নং ওয়ার্ডের এমআরবি রহিমা ব্রিকস, ৭নং ওয়ার্ড মদিনা ব্রিকস, ৮নং ওয়ার্ডে নবাব ব্রিকস ও ৪নং ওয়ার্ডের গুলশান ব্রিকস ও চরকাদিরা ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের সুমাইয়া ব্রিকস, আল্লার দান, ৫নং ওয়ার্ডে রহিমা ব্রিকস, ৯নং ওয়ার্ডের চরবসু এলাকায় আকাশ ব্রিকস, ৪নং ওয়ার্ডে ভাই ভাই ব্রিকস, হাজিরহাট ইউনিয়নের মিয়াপাড়া মা ফাতেমা ব্রিকস ও চরকালকিনি ১নং ওয়ার্ডের শামিম ব্রিকসসহ মোট ১৪টি অবৈধ ইটভাটা চলছে।
রামগতি উপজেলার চররমিজ ইউনিয়নের চরআফজল গ্রামের ইউনিয়ন পরিষদের ৫ ও ৬নং ওয়ার্ডজুড়ে ইটভাটার ছড়াছড়ি। এ গ্রামে গড়ে উঠা ভাটাগুলো হল, এডব্লিউবি, এসবিএম, এফএবি, এডব্লিউবিটু, টিবিএল, এসিবি, আরবিএম, এবিএম, বিবিএম, এএমআরই, এসএসবি, এআরবি, এফএমবি, পিবিএম, এসএবি, এমএসবি, এএমএ, বিবিএল, এমবিএল, জেএসবি, এমপিবি, ফাইভস্টার ও ফোরস্টার।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, ভাটার চারপাশে থাকা ফসলি জমিতে বেড়ে ওঠা ধান, সয়াবিন, বাদামগাছসহ বিভিন্ন রবিশস্য ঝুঁকিতে পড়েছে। ইট তৈরিতে ব্যবহৃত মাটির সবটাই যাচ্ছে ফসলি জমি থেকে। তাদের অভিযোগ, কৃষিজমি রক্ষায় কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না উপজেলা প্রশাসন ও কৃষি বিভাগ, নজরদারি নেই পরিবেশ অধিদপ্তরেরও।
রামগতির চরআফজল গ্রামের কৃষক জমির উদ্দিনের ভাষ্য, একটি ইটভাটা থেকে অন্যটির দূরত্ব বেশি নয়। সব ভাটা স্থাপন করা হয়েছে ফসলি জমির মাঝখানে। এভাবে চলতে থাকলে তারা ফসল ফলাবেন কী করে? ফসলের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় অবৈধ ইটভাটার দাপটে রামগতি-কমলনগর উপজেলা মরুভূমিতে রূপান্তরিত হবে বলে মনে করেন একই গ্রামের কলেজছাত্র শরীফুল ইসলাম।
বাসিন্দারা বলছেন, ইটভাটা বাড়তে থাকায় দক্ষিণাঞ্চলের কৃষিভিত্তিক ও নদী ভাঙনকবলিত এলাকার গ্রামীণ সড়ক এক বছরও টিকছে না। মাটি আনা হয় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্মিত গ্রামীণ সড়ক দিয়ে। ফলে এসব সড়ক লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে। তৈরি হয়েছে পরিবেশগত ব্যাপক বিশৃঙ্খলা।
চরআফজলের আরেক বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, এক গ্রামে এতগুলো ইটভাটা ভাবতেই অবাক লাগে। ভাটার পাশেই বসতবাড়ি, হাটবাজার ও গাছপালার বাগান। নতুন ভাটার কারণে গ্রামে আর বসবাসের পরিবেশই থাকবে না।
ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৯ থেকে জানা গেছে, একটি ইটভাটা স্থাপনের আগে সরকারের ১০টি দপ্তরের নজর পার হতে হয়। এ আইনের উদ্দেশ্য ছিল ২০২০ সালের মধ্যে পোড়া ইট শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা। তবে এ অঞ্চলে উলটো প্রতি বছরই ভাটার সংখ্যা বাড়ছে।
বিশেষ কোনো স্থাপনা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও ক্লিনিক এবং লোকালয়ের অন্তত এক কিলোমিটারের মধ্যে ভাটা স্থাপনের বিধিনিষেধ রয়েছে। তাছাড়া আবাদি জমিতে ভাটা তৈরি, কৃষিজমির মাটি ব্যবহার, এলজিইডির সড়ক ব্যবহার ও কাঠ পোড়ানোতেও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে এর কিছুই মানছেন না স্থানীয় ভাটার মালিকরা।
তিশা ব্রিকস লিমিটেডের (টিবিএল) মালিক ছানা উল্যাহ উপজেলা ব্রিকস ফিল্ড মালিক সমিতি ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর সাধারণ সম্পাদক। তিনি স্বীকার করেন, উপজেলায় অনেক অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। ছানা উল্যাহর ভাষ্য, আমরা অনেকে বৈধ কাগজপত্রের জন্য আবেদন করেছি। এখন আপাতত প্রশাসনকে ম্যানেজ করে চালাচ্ছি।
সংগঠনের সভাপতি হাজি খলিল উল্যাহ বলেন, এ অঞ্চলের অধিকাংশ ইটভাটা অবৈধ। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানের মালিক লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছেন। প্রশাসন অভিযান চালালে কী করবেন- এমন প্রশ্নে বলেন,চেয়ে চেয়ে দেখব। আর কী করব। বিভিন্ন দিবস পালনের নামে প্রশাসন ও পুলিশ আমাদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে। আমাদের ভাটাগুলো ম্যানেজের দায়িত্বে থাকা আতিকের সঙ্গে আপনারা কথা বলেন।
লক্ষ্মীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক হারুনুর রশিদ বলেন, রামগতি-কমলনগর উপজেলায় কৃষি জমি নষ্ট করে গড়ে উঠেছে প্রায় ৬০টির মতো অবৈধ ইটভাটা। আমাদেরকে অবহিত না করে কীভাবে তারা ইটভাটাগুলো স্থাপন করছেন এমন প্রশ্ন রাখেন তিনি।
রামগতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ আমজাদ হোসেন জানান, হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী এ উপজেলায় ৪০টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে লাইসেন্স রয়েছে মাত্র দুটির। তবে কয়েকটির মালিকপক্ষ আবেদন করেছে।
কমলনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুচিত্র রঞ্জন দাস বলেন, এ উপজেলায় ১৪টি অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। অচিরেই অভিযান পরিচালনা করা হবে। কোনো অবস্থাতেই অবৈধ ইটভাটা চলতে পারবে না।
লক্ষ্মীপুরের জেলা প্রশাসক রাজিব কুমার সরকার যোগাযোগ প্রতিদিনকে বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে কথা বলে এসব অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হবে।
এম/এস/এস